অনুশীলনীর প্রশ্নোত্তর
- অতি সংক্ষিপ্ত উত্তর দাও
প্রশ্ন ১। মহাত্মা গান্ধির জন্ম কবে হয়েছিল ?
উত্তরঃ ১৮৬৯ সালের ২ রা অক্টোবর ।
প্রশ্ন ২। সত্যাগ্রহের কৌশল গান্ধি কোন দেশে সর্বপ্রথম প্রয়োগ করেছিলেন ?
উত্তরঃ দক্ষিণ আমেরিকায় ।
প্রশ্ন ৩। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কেন ‘ নাইট ’ উপাধি ত্যাগ করেছিলেন ?
উত্তরঃ জালিয়ান ওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ।
প্রশ্ন ৪। কার কার নেতৃত্বে ভারতে খিলাফৎ আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল ?
উত্তরঃ মৌলানা সৌকত আলি ও মহম্মদ আলির নেতৃত্বে ।
প্রশ্ন ৫। চৌরিচৌরার ঘটনা কখন সংঘটিত হয়েছিল ?
উত্তরঃ ১৯২২ সালের ৫ ই ফ্রেব্রুয়ারী ।
প্রশ্ন ৬। কেমন পরিস্থিতিতে লালা লাজপত রায়ের মৃত্যু হয়েছিল ?
উত্তরঃ সাইমন বিরোধী মিছিলে পুলিশের লাঠির আঘাতে ।
প্রশ্ন ৭। কখন এবং কোন অধিবেশনে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ভারতবাসীদের মূল দাবি হিসাবে পূর্ণ স্বরাজের দাবি উত্থাপন করেছিল ?
উত্তরঃ ১৯২৯ সালের লাহোর অধিবেশনে ।
প্রশ্ন ৮। গান্ধিজি সবরমতী আশ্রম থেকে দাণ্ডির সাগর পার অবধি লবণ আইন ভঙ্গ করতে গিয়েছিলেন । সবরমতী আশ্রম এবং দাণ্ডির মধ্যে দূরত্ব কতদূর ?
উত্তরঃ ৩৮৫ কিঃ মিঃ ।
প্রশ্ন ৯। সীমান্ত গান্ধি নামে পরিচিত কে ?
উত্তরঃ খান আবদুল গফর খান ।
প্রশ্ন ১০। লণ্ডনে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠকে কে কংগ্রেসকে এককভাবে প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন ?
উত্তরঃ গান্ধিজি ।
প্রশ্ন ১১। ১৯৩২ সালে সাম্প্রদায়িক বাটোয়ারা ঘোষণাকারী ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর নাম কী ?
উত্তরঃ রামসে ম্যাকডনাল্ড ।
প্রশ্ন ১২। কোন আন্দোলনের সময় গান্ধিজি “ করব কিংবা মরব ” শ্লোগান দিয়েছিলেন ?
উত্তরঃ ভারত ত্যাগ আন্দোলনের সময় ।
প্রশ্ন ১৩। আজাদ হিন্দ ফৌজের প্রতিষ্ঠাতা কে ?
উত্তরঃ কেপ্টেন মোহন সিং ।
প্রশ্ন ১৪। “ আমাকে রক্ত দাও , আমি তোমাদের স্বাধীনতা দিব ” এই বিখ্যাত বাণীটি কোন ভারতীয় নেতার ?
উত্তরঃ নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর ।
প্রশ্ন ১৫। ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যেকার সীমারেখাকে কী নামে জানা যায় ?
উত্তরঃ রেডক্লিপ রেখা ।
দীর্ঘ উত্তর লেখো
প্রশ্ন ১। সত্যাগ্রহ বলতে কী বোঝ ? যে তিনটি স্থানীয় বিবাদের ক্ষেত্রে গান্ধি সত্যাগ্রহকে প্রথম প্রয়োগ করেছিলেন সেই তিনটির বিষয়ে সংক্ষিপ্ত লেখো ।
উত্তরঃ সত্যাগ্রহ:‘সত্যাগ্রহ’ শব্দটি ‘সত্য’ এবং ‘আগ্রহ’ শব্দের সমন্বয়ে গঠিত। এর মানে হল “সত্যের প্রতি আগ্রহ” বা সত্যান্বেষণ। গান্ধিজির মতে, সত্যাগ্রহ একটি অহিংস আন্দোলন যা জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা সৃষ্টি করে। এটি একপক্ষীয় প্রতিরোধ নয়, বরং গণমানুষের নৈতিক ও রাজনৈতিক সংগ্রাম। গান্ধীজি সত্যাগ্রহের ধারণায় প্রভাবিত হয়েছিলেন লিও টলস্টয় ও হেনরি থোরোর লেখনী থেকে।
স্থানীয় বিবাদের ক্ষেত্রে সত্যাগ্রহের প্রয়োগ:
গান্ধীজি প্রথম তিনটি স্থানীয় বিবাদে সত্যাগ্রহ প্রয়োগ করেন:
- চম্পারণ (১৯১৭-১৮): উত্তর বিহারের চম্পারণে কৃষকরা ভূমিদাতাদের অত্যাচারের শিকার হয়েছিলেন। গান্ধীজি তাদের নেতৃত্বে অহিংস সত্যাগ্রহ শুরু করেন, যা চম্পারণ সত্যাগ্রহ নামে পরিচিত।
- খেড়া (১৯১৮): গুজরাটের খেড়া অঞ্চলে কৃষকদের ফসলের ক্ষতির পরও সরকারের অতিরিক্ত কর চাপানো হয়। গান্ধীজি তাদের পক্ষ হয়ে অহিংস সত্যাগ্রহ শুরু করেন, এবং কৃষকদের স্বার্থ রক্ষার জন্য সংগ্রাম করেন।
- আহমেদাবাদ (১৯১৮): প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর আহমেদাবাদের শ্রমিকরা দুর্দশার শিকার হন। গান্ধীজি তাদের সহায়তার জন্য অহিংস সত্যাগ্রহ শুরু করেন, এবং শ্রমিকদের স্বার্থে উদ্যোগপতিদের বিরুদ্ধে আন্দোলন পরিচালনা করেন।
খিলাফৎ আন্দোলন:
খিলাফৎ আন্দোলন তুরস্কে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে যুদ্ধ করা তুর্কি সাম্রাজ্যের পতন ও সুলতান খলিফার পদবির অবমাননা নিয়ে শুরু হয়। ভারতের মুসলমান সমাজ এই আন্দোলনের অংশ হয়ে ওঠে। গান্ধীজি খিলাফৎ আন্দোলনকে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করেন এবং এর সাথে অসহযোগ আন্দোলনকে যুক্ত করেন। ১৯১৯ সালে ‘নিখিল ভারত খিলাফৎ সম্মেলন’ গঠন হয়, যেখানে গান্ধীজি সভাপতি নির্বাচিত হন।
৩। ১৯২০-২২ সালে গান্ধিজি কেন অসহযোগ আন্দোলন আরম্ভ করেছিলেন ? এর কার্যসূচি কী ছিল ? গান্ধিজি কেন এই আন্দোলন বন্ধ করে দিয়েছিলেন ?
উত্তরঃ ১৯১৯ সালে ব্রিটিশ সরকার ভারতীয়দের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে ব্যর্থ হয়। বিশেষ করে রাওলাট আইন, যা বিনা বিচারে কাউকে আটক করার অধিকার দিত, ভারতীয় জনগণের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি করে। এই আইন এবং তার পরবর্তী সামরিক দমননীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু হয়। ১৩ এপ্রিল ১৯১৯ তারিখে পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগে ব্রিটিশ সেনা দ্বারা গুলি চালানো হয়, যাতে অনেক নিরস্ত্র মানুষ নিহত হয়। এই ঘটনার প্রতিবাদে গান্ধীজি ১৯২০ সালে অসহযোগ আন্দোলন শুরু করেন।
গান্ধীজি এই আন্দোলনে অহিংসার ভিত্তিতে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে ভারতবাসীকে আহ্বান জানান। তিনি কংগ্রেসের সাথে খিলাফৎ আন্দোলনও সংযুক্ত করেন। আন্দোলনের কার্যসূচি ছিল—পাঞ্জাবে ব্রিটিশ অত্যাচারের প্রতিবাদ, তুর্কি সাম্রাজ্যের ওপর ব্রিটিশ অবিচারের প্রতিবাদ এবং ভারত স্বরাজ প্রতিষ্ঠা। গান্ধীজি জনগণকে স্কুল, কলেজ, সরকারি চাকরি, আইনসভা ও আদালত বর্জন, জমির খাজনা না দেওয়া, বিদেশি দ্রব্য বয়কট এবং চরকায় সূতা কাটার আহ্বান করেন।
কিন্তু চৌরিচৌরায় পুলিশের অত্যাচারের প্রতিবাদে জনতার হিংসাত্মক আন্দোলন সংঘটিত হয়, যার ফলে গান্ধীজি আন্দোলন প্রত্যাহার করেন। এই সিদ্ধান্তে অনেক নেতার মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়, তবে গান্ধীজির নেতৃত্বে ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রাম নতুন একটি দিক পায়। ১৯২২ সালে খিলাফৎ আন্দোলনও শেষ হয় এবং অসহযোগ আন্দোলনও বন্ধ হয়ে যায়।
প্রশ্ন ৪। আইন অমান্য আন্দোলনের মূল লক্ষ্য কী ছিল ? এই আন্দোলনের মূল বৈশিষ্ট্য কী ?
উত্তরঃ ১৯৩০ সালে আইন অমান্য আন্দোলন শুরু হয়, যখন গান্ধীজি ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে পূর্ণ স্বরাজের দাবি তোলেন। তিনি নেহেরু রিপোর্টের সিদ্ধান্ত স্মরণ করিয়ে ভারতের ডোমিনিয়নের মর্যাদা দাবি করেন। এর পর, ব্রিটিশ সরকার গান্ধীসহ অন্যান্য নেতাদের গ্রেফতার করে। এই সময়ে ১৯২৩ সালে লবণের উপর দ্বিগুণ কর চাপানো হয়, যা সাধারণ মানুষের জন্য অত্যন্ত কষ্টকর ছিল। গান্ধীজি লর্ড আরউইনকে লবণ আইন বাতিল করার জন্য প্রস্তাব দেন, কিন্তু তা নাকচ হয়ে গেলে তিনি লবণ সত্যাগ্রহের মাধ্যমে আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করেন।
১২ মার্চ, ১৯৩০ সালে গান্ধীজি সবরমতী আশ্রম থেকে ৭৯ জন সহকর্মী নিয়ে দাণ্ডির দিকে পদযাত্রা শুরু করেন। ৬ এপ্রিল, দাণ্ডিতে তিনি লবণ তৈরি করে সরকারি লবণ আইন লঙ্ঘন করেন, যা সারাদেশে এক নতুন আন্দোলনের সূচনা করে। ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে মানুষ এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে, লবণ তৈরি, বিদেশি দ্রব্য বয়কট এবং ধর্মঘটের মাধ্যমে আন্দোলনকে আরও শক্তিশালী করে তোলে।
সরকার এই আন্দোলন দমনে চরম দমনমূলক নীতি গ্রহণ করে, বহু সত্যাগ্রহীকে গ্রেফতার এবং সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়। 60,000 এরও বেশি সত্যাগ্রহী গ্রেফতার হন।
প্রশ্ন ৫। কী পরিস্থিতিতে ভারত ত্যাগ আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল ? ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে এই আন্দোলনের কার্যসূচিকে তুমি মাইল স্টোন রূপে সাধ্যস্ত করতে চাও ? তোমার মতামতের সমর্থনে যুক্তি দাও ।
উত্তরঃ ভারত ত্যাগ আন্দোলন ১৯৪২ সালে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে এক বৃহৎ সংগ্রামের সূচনা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের ভারত আক্রমণের সম্ভাবনা দেখা দেওয়ার পর, ব্রিটিশ সরকার ভারতের সহযোগিতা চাইতে স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপসকে প্রেরণ করে। কিন্তু ক্রিপসের প্রস্তাবে স্বাধীনতার কোনো উল্লেখ না থাকায় কংগ্রেস তা প্রত্যাখ্যান করে। এর পর, মহাত্মা গান্ধী “ভারত ত্যাগ” আন্দোলনের ডাক দেন এবং ১৯৪২ সালের ৮ আগস্ট মুম্বাইয়ে কংগ্রেস কর্মসূচি অনুমোদিত হয়। গান্ধী স্পষ্টভাবে বলেন, “যতদিন ব্রিটিশরা ভারতে থাকবে, ততদিন জাপান থাকবে না।”
এ আন্দোলনের ফলস্বরূপ, ৯ আগস্ট কংগ্রেস নেতাদের গ্রেপ্তার করা হয়। কিন্তু, জনগণ নেতা ছাড়াই ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। ভারতজুড়ে বিক্ষোভ, হামলা এবং ভাংচুর শুরু হয়, বহু সরকারি প্রতিষ্ঠান ও সম্পত্তি ধ্বংস করা হয়। মেদিনীপুর, বালিয়া ও ভাগলপুরের মতো এলাকায় স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়।
ব্রিটিশ সরকার কঠোর দমননীতি অবলম্বন করে, হাজার হাজার মানুষ গুলিবিদ্ধ ও গ্রেপ্তার হয়। মহাত্মা গান্ধী হিংসা বিরোধী আন্দোলনে অনশনে বসেন, যা দেশবাসীর সমর্থন লাভ করে। শেষপর্যন্ত, ব্রিটিশ সরকার গান্ধীকে মুক্তি দেয়। ভারত ত্যাগ আন্দোলন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে এক মাইলস্টোন হিসেবে চিহ্নিত হয়, কারণ এটি জনগণের মধ্যে বৃহত্তর সংগ্রামী চেতনা সৃষ্টি করেছিল।
প্রশ্ন ৬। ভারতীয় জাতীয় সেনাবাহিনীর বিষয়ে একটি টীকা লেখো ।
উত্তরঃ সুভাষচন্দ্র বসু ছিলেন এক অবিস্মরণীয় বিপ্লবী নেতা, যিনি ভারতীয় জাতীয় সেনাবাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা এবং আজাদ হিন্দ ফৌজের নেতৃত্বদানকারী ছিলেন। ১৯২৮ সালে কলকাতা কংগ্রেসে সুভাষচন্দ্র এবং জওহরলাল নেহরু পূর্ণ স্বাধীনতার দাবিতে মুখরিত হন। ১৯৩৮ সালে হরিপুরা কংগ্রেসে তিনি কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন, কিন্তু মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে মতবিরোধের কারণে ১৯৩৯ সালে কংগ্রেসের সভাপতি হিসেবে পুনরায় নির্বাচিত হন। পরে তিনি কংগ্রেস থেকে বের হয়ে “ফরওয়ার্ড ব্লক” গঠন করেন।
১৯৪১ সালে সুভাষচন্দ্র বসু ইংরেজ শাসকদের হাতে বন্দী হলেও, তিনি জেলের বেড়া ভেঙে পালিয়ে যান। প্রথমে তিনি জার্মানিতে যান এবং সেখান থেকে জাপানে পৌঁছান। জাপান এবং জার্মানীর সাহায্যে তিনি আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠন করেন, যার লক্ষ্য ছিল ভারতকে স্বাধীন করা। সিঙ্গাপুরে আজাদ হিন্দ সরকার প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর নেতৃত্বে, আজাদ হিন্দ ফৌজ ভারতীয় সৈন্যদের নিয়ে দেশের স্বাধীনতার জন্য লড়াই শুরু করে।
কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে, খাদ্যাভাব ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে তারা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। ১৯৪৫ সালের ১৮ আগস্ট, সুভাষচন্দ্র বসুর মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়, তবে তার মৃত্যু সম্পর্কে এখনো কোনো নিশ্চিত সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু ভারতবাসীর হৃদয়ে চিরকাল অমর থাকবেন।