ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের প্রতিষ্ঠা সম্প্রসারণ এবং সুদৃঢকরণ এর ভিতরের এবং অনুশীলনীর প্রশ্নোত্তর
এখানে পাঠ্যপুস্তকের ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের প্রতিষ্ঠা সম্প্রসারণ এবং সুদৃঢকরণ থাকা সমস্ত প্রশ্ন এবং তার উত্তর দেওয়া হল।
অনুশীলনী
১। উত্তর দাও
(ক) ইংরেজ এবং ফরাসিদের মধ্যে কীসের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছিল?
উত্তর: ইংরেজ এবং ফরাসি উভয় ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানিই মুঘল সাম্রাজ্য এবং অন্যান্য দেশীয় রাজ্যগুলোর দুর্বলতা বুঝতে পেরে ভারতবর্ষে নিজেদের সাম্রাজ্য গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখছিল। ভারতবর্ষে রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তার করাই ছিল এই দুই শক্তির প্রতিদ্বন্দ্বিতার মূল কারণ।
(খ) প্রথম এবং দ্বিতীয় কর্ণাটক যুদ্ধের সময়ে ফরাসিদের গভর্নর কে ছিলেন?
উত্তর: প্রথম এবং দ্বিতীয় কর্ণাটক যুদ্ধের সময়ে ফরাসিদের গভর্নর ছিলেন যোশেফ ফ্রান্সিস ডুপ্লে।
(গ) নবাব সিরাজ-উদ্-দৌল্লার প্রধান সেনাপতি কে ছিলেন?
উত্তর: নবাব সিরাজ-উদ্-দৌল্লার প্রধান সেনাপতি ছিলেন মিরজাফর।
(ঘ) বঙ্গদেশের প্রথম গভর্নর জেনারেল কে ছিলেন?
উত্তর: ১৭৭৩ সালের রেগুলেটিং অ্যাক্ট অনুযায়ী বঙ্গদেশের গভর্নরের পদটিকে গভর্নর জেনারেলে উন্নীত করা হয়েছিল। এই আইন অনুসারে ওয়ারেন হেস্টিংস ছিলেন বঙ্গদেশের প্রথম গভর্নর জেনারেল।
(ঙ) স্বত্ববিলোপ নীতি কে প্রবর্তন করেছিলেন?
উত্তর: লর্ড ডালহৌসি স্বত্ববিলোপ নীতি প্রয়োগ করে একাধিক রাজ্য ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন।
২। শুদ্ধ উত্তর বেছে বের করো-
(ক) পণ্ডিচেরী ইংরেজদের বাণিজ্য কুঠি ছিল।
উত্তর: অশুদ্ধ। পণ্ডিচেরী ছিল ফরাসিদের প্রধান ঘাঁটি।
(খ) ফরাসিরা সালাবৎ জং কে হায়দারাবাদের নিজাম হিসাবে অধিষ্ঠিত করেছিল।
উত্তর: শুদ্ধ।
(গ) নবাব সিরাজ-উদ-দৌল্লা আলিবর্দি খাঁর জ্যেষ্ঠা কন্যার পুত্র ছিলেন।
উত্তর: অশুদ্ধ। সিরাজ-উদ-দৌল্লা ছিলেন আলিবর্দি খাঁর কনিষ্ঠা কন্যার পুত্র।
(ঘ) পলাশি অঞ্চলটি ভাগিরথী নদীর পারে অবস্থিত ছিল।
উত্তর: শুদ্ধ।
(ঙ) রেগুলেটিং অ্যাক্ট বঙ্গের গভর্নর পদটিকে গভর্নর জেনারেলে উন্নীত করে।
উত্তর: শুদ্ধ।
(চ) লর্ড ওয়েলেসলি স্বত্ব বিলোপ নীতি প্রবর্তন করেন।
উত্তর: অশুদ্ধ। লর্ড ওয়েলেসলি ‘করদ মৈত্রী’ নীতি প্রবর্তন করেন।
৩। ক্রমানুসারে সাজাও-
নবাব সিরাজ-উদ-দৌল্লা, মিরজাফর, আলিবর্দি খাঁ, মিরকাশিম।
উত্তর: সঠিক ক্রমটি হলো:
১. আলিবর্দি খাঁ
২. নবাব সিরাজ-উদ-দৌল্লা
৩. মিরজাফর
৪. মিরকাশিম
৪। সংক্ষিপ্ত উত্তর দাও-
(ক) প্রথম কর্ণাটক যুদ্ধ
উত্তর: ইউরোপে অস্ট্রিয়ার উত্তরাধিকার যুদ্ধ শুরু হলে তার প্রভাব ভারতেও পড়ে। ১৭৪৫ সালে ইংরেজ নৌবাহিনী ফরাসি জাহাজ আটক করলে ফরাসি গভর্নর ডুপ্লে ইংরেজদের অধীন মাদ্রাজ দখল করেন। ফরাসিরা কর্ণাটকের নবাবের বিশাল সৈন্যবাহিনীকেও পরাজিত করে। পরে ইউরোপে দুই শক্তির মধ্যে সন্ধি হলে ভারতেও যুদ্ধ শেষ হয় এবং ফরাসিরা মাদ্রাজ ইংরেজদের ফিরিয়ে দেয়। এটিই প্রথম কর্ণাটক যুদ্ধ নামে পরিচিত।
(খ) ডুপ্লে
উত্তর: যোশেফ ফ্রান্সিস ডুপ্লে ছিলেন পণ্ডিচেরীর ফরাসি গভর্নর। তিনি একজন চতুর, দূরদর্শী এবং তীক্ষ্ণবুদ্ধিসম্পন্ন শাসক ছিলেন। প্রথম কর্ণাটক যুদ্ধে তিনি ইংরেজদের থেকে মাদ্রাজ দখল করেন। পরে হায়দরাবাদ এবং কর্ণাটকের সিংহাসন সংক্রান্ত বিবাদে হস্তক্ষেপ করে তিনি মুজাফ্ফর জং এবং চাঁদ সাহেবকে সমর্থন করেন এবং দাক্ষিণাত্যে ফরাসিদের প্রভাব বিস্তর বৃদ্ধি করেন।
(গ) পলাশির যুদ্ধ
উত্তর: ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে ভাগিরথী নদীর তীরে পলাশির প্রান্তরে নবাব সিরাজ-উদ্-দৌল্লার সঙ্গে ইংরেজদের এই যুদ্ধ হয়। রবার্ট ক্লাইভ নবাবের বিরুদ্ধে সন্ধি ভঙ্গের মিথ্যা অভিযোগ এনে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। নবাবের প্রধান সেনাপতি মিরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে মিরমদন এবং মোহনলালের বীরত্ব সত্ত্বেও নবাবের বাহিনী পরাজিত হয়। এই যুদ্ধের পরেই বাংলায় তথা সমগ্র ভারতবর্ষে ইংরেজদের প্রভুত্ব বিস্তারের পথ সুগম হয়।
(ঘ) রেগুলেটিং অ্যাক্ট
উত্তর: ভারতবর্ষে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ব্রিটিশ সংসদ ১৭৭৩ খ্রিস্টাব্দে রেগুলেটিং অ্যাক্ট চালু করে। এই আইন অনুসারে, বঙ্গদেশের গভর্নরের পদটিকে ‘গভর্নর জেনারেল’ পদে উন্নীত করা হয় এবং বোম্বাই ও মাদ্রাজের গভর্নরকে তার অধীনস্থ করা হয়। এই আইনের মাধ্যমে ভারতে কোম্পানির রাজনৈতিক কাজকে স্বীকৃতি দেওয়া হয় এবং স্থায়ী ব্রিটিশ শাসনের ভিত্তি স্থাপন করা হয়।
(ঙ) পিটের ভারত শাসন আইন
উত্তর: রেগুলেটিং অ্যাক্টের ত্রুটিগুলো দূর করতে ব্রিটিশ সংসদ ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে পিটের ভারত শাসন আইন পাশ করে। এই আইন অনুসারে ইংল্যান্ডে একটি নিয়ন্ত্রক মণ্ডলী বা ‘বোর্ড অফ কন্ট্রোল’ গঠন করা হয়, যা ভারতে কোম্পানির কাজকর্ম তদারকি করত। এর মাধ্যমে গভর্নর জেনারেলের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং ভারতে কেন্দ্রীয় শাসনের সূচনা হয়।
(চ) চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত
উত্তর: গভর্নর জেনারেল লর্ড কর্নওয়ালিস কোম্পানির রাজস্ব বিভাগকে শক্তিশালী করার জন্য ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ প্রবর্তন করেন। এই ব্যবস্থায় জমিদারদেরকে নির্দিষ্ট পরিমাণ রাজস্বের বিনিময়ে জমির স্থায়ী মালিকানা দেওয়া হয়। এর ফলে কোম্পানির একটি নিশ্চিত আয় হয় এবং জমিদার নামে এক নতুন ইংরেজ-অনুগত শ্রেণির উত্থান ঘটে, যারা পরবর্তীকালে ব্রিটিশদের সাহায্য করেছিল।
৫। ‘বঙ্গের ঘরোয়া কোন্দলই ইংরেজদের বঙ্গ দখলের প্রধান কারণ’ — কথাগুলোর যথার্থতা নির্ণয় করো।
উত্তর: এই কথাটি অনেকাংশে যথার্থ।
১৭৫৬ সালে নবাব আলিবর্দি খাঁর মৃত্যুর পর তাঁর কোনো পুত্রসন্তান না থাকায় সিংহাসনকে কেন্দ্র করে বিবাদ শুরু হয়। আলিবর্দি খাঁ তাঁর কনিষ্ঠা কন্যার পুত্র সিরাজ-উদ্-দৌল্লাকে নবাব মনোনীত করলেও, তাঁর জ্যেষ্ঠা কন্যা ঘসিটি বেগম এবং মধ্যম কন্যার পুত্র শওকত জং সিংহাসনের দাবিদার ছিলেন। ঘসিটি বেগম, দেওয়ান রাজবল্লভ প্রমুখ সিরাজের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন।
ইংরেজরা এই ঘরোয়া কোন্দলের পূর্ণ সুযোগ নেয়। পলাশির যুদ্ধের আগে রবার্ট ক্লাইভ নবাবকে সিংহাসনচ্যুত করার জন্য যে ষড়যন্ত্র করেন, তাতে নবাবের প্রধান সেনাপতি মিরজাফর, দেওয়ান রাজবল্লভ, রায়দুর্লভ এবং ব্যবসায়ী জগৎ শেঠের মতো প্রভাবশালী ব্যক্তিরা যোগ দেন। এই অভ্যন্তরীণ বিশ্বাসঘাতকতাই পলাশির যুদ্ধে নবাবের পরাজয় এবং বাংলায় ইংরেজদের ক্ষমতা দখলের পথ সহজ করে দিয়েছিল।
৬। বৃটিশ ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির কী ধরনের কাজকর্ম নবাব সিরাজ-উদ্-দৌল্লাকে অসন্তুষ্ট করেছিল?
উত্তর: ব্রিটিশ ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির নিম্নলিখিত কাজকর্মগুলো নবাব সিরাজ-উদ্-দৌল্লাকে অসন্তুষ্ট করেছিল:
* দুর্গ নির্মাণ: নবাবের আদেশ অমান্য করে ইংরেজরা কলকাতায় সামরিক দুর্গ নির্মাণ চালিয়ে যাচ্ছিল।
* ‘দস্তক’-এর অপব্যবহার: ইংরেজ কোম্পানিকে দেওয়া বিনাশুল্কে বাণিজ্য করার ছাড়পত্র বা ‘দস্তক’-এর অপব্যবহার করা হচ্ছিল। কোম্পানির কর্মচারীরা নিজেদের ব্যক্তিগত ব্যবসার জন্যও এটি ব্যবহার করত, যার ফলে নবাব রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছিলেন।
* আশ্রয় দান: নবাবের কর্মচারী দেওয়ান রাজবল্লভের পুত্র কৃষ্ণদাসকে নবাবের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ইংরেজরা কলকাতায় আশ্রয় দিয়েছিল।
এইসব কারণে নবাব ইংরেজদের উপর ক্ষুব্ধ হন এবং তাদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালান।
৭। ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির সাম্রাজ্যবাদী নীতি কী কী কার্যাবলির দ্বারা প্রকাশ পেয়েছিল আলোচনা করো।
উত্তর: ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির সাম্রাজ্যবাদী নীতি বিভিন্ন কার্যাবলির মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছিল। এর মধ্যে প্রধান তিনটি হলো:
* করদ মৈত্রী নীতি (Subsidiary Alliance): লর্ড ওয়েলেসলি প্রবর্তিত এই নীতি অনুযায়ী, দেশীয় রাজাদের ইংরেজ সৈন্যবাহিনীর সুরক্ষার বিনিময়ে সেই সৈন্যের খরচ বহন করতে হতো। এই নীতি গ্রহণকারী রাজারা কার্যত স্বাধীনতা হারাতেন এবং অযোগ্যতার অভিযোগে তাদের রাজ্য কোম্পানি সরাসরি দখল করে নিতে পারত। এর মাধ্যমে বহু রাজ্য ইংরেজদের অধীনে আসে।
* স্বত্ব বিলোপ নীতি (Doctrine of Lapse): এই নীতি অনুসারে, কোম্পানির আশ্রিত কোনো রাজ্যের রাজার পুত্রসন্তান না থাকলে এবং তিনি কোম্পানির অনুমতি ছাড়া দত্তক নিলে সেই রাজ্য ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যেত। লর্ড ডালহৌসি এই নীতির ব্যাপক প্রয়োগ করে সাতারা, নাগপুর, ঝাঁসি ইত্যাদি বহু রাজ্য দখল করেন।
* চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত (Permanent Settlement): এটি একটি রাজস্ব নীতি হলেও এর একটি সাম্রাজ্যবাদী দিক ছিল। এর মাধ্যমে ইংরেজদের অনুগত এক জমিদার শ্রেণি তৈরি হয়েছিল, যারা প্রয়োজনে ব্রিটিশ শাসনকে সমর্থন করত।
এই নীতিগুলোর মাধ্যমে কোম্পানি কূটনীতি ও কৌশলের দ্বারা সমগ্র ভারতে নিজেদের সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিল।
৮। লর্ড ডালহৌসি স্বত্ববিলোপ নীতি প্রয়োগ করে কোন কোন রাজ্যগুলি কোম্পানির শাসনাধীনে এনেছিলেন তার একটি তালিকা প্রস্তুত করো।
উত্তর: লর্ড ডালহৌসি স্বত্ববিলোপ নীতি প্রয়োগ করে নিম্নলিখিত রাজ্যগুলি কোম্পানির শাসনাধীনে এনেছিলেন:
* মন্দতি (১৮৩৯)
* কোলাবা (১৮৪০)
* সাঁতারা (১৮৪৪)
* জৈৎপুর (১৮৪৪)
* সম্বলপুর (১৮৪৪)
* ভাগলপুর
* উদয়পুর
* নাগপুর
* ঝাঁসি
৯ এবং ১০ নং প্রশ্ন দুটি মানচিত্র-ভিত্তিক কাজ।
* ৯ নং প্রশ্ন: ভারতবর্ষের মানচিত্রে পণ্ডিচেরী, মাদ্রাজ, বোম্বাই, এলাহাবাদ, অযোধ্যা, পলাশি, কর্ণাটক ইত্যাদি স্থানগুলো চিহ্নিত করতে বলা হয়েছে।
* ১০ নং প্রশ্ন: ইউরোপের মানচিত্রে অস্ট্রিয়া, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি ইত্যাদি দেশগুলো খুঁজে বের করতে বলা হয়েছে।
*
