ভারতবর্ষে ইউরোপীয়দের ব্যবসায়ীদের আগমন, Class – 8, SEBA

ভারতবর্ষে ইউরোপীয়দের ব্যবসায়ীদের আগমন


ভারতবর্ষে ইউরোপীয়দের ব্যবসায়ীদের আগমন

এখানে পাঠ্যপুস্তকের সমস্ত প্রশ্ন ও তার উত্তর প্রদান করা হলো।
ক্রিয়াকলাপ (পৃষ্ঠা ৪৯)
• কোন কোন ইউরোপীয় দেশ ভারতবর্ষে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে এসেছিল? ক্রমানুসারে উল্লেখ করো।
উত্তর: ভারতবর্ষে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে আসা ইউরোপীয় দেশগুলো হলো:
* পর্তুগাল (পোর্তুগিজ)
* নেদারল্যান্ডস (ওলন্দাজ বা ডাচ)
* গ্রেট ব্রিটেন (ইংরেজ বা ব্রিটিশ)
* ফ্রান্স (ফরাসি)
   এছাড়াও ডেনিস, প্রুশিয়ান, সুইস এবং অস্ট্রিয়ানরাও বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করেছিল।
উত্তর লেখো (পৃষ্ঠা ৫১)
• ইউরোপীয়দের কাছে ভারতবর্ষ কিসের জন্য আকর্ষনীয় ছিল?
উত্তর: ভারতবর্ষের মশলা, বস্ত্র, রেশম, ধাতব সামগ্রী, সোনা, রুপা এবং মূল্যবান পাথরের ইউরোপীয় বাজারে প্রচুর চাহিদা থাকায় ভারতবর্ষ ইউরোপীয়দের কাছে আকর্ষণীয় ছিল।
• ইউরোপের কোন কোন রাষ্ট্রের অর্থনীতির মূল ভিত্তি সাম্রাজ্যবাদ ছিল?
উত্তর: সেই সময়ে ইংল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, স্পেন, পর্তুগাল, ফ্রান্স এবং ডেনমার্ক ইত্যাদি রাষ্ট্রের অর্থনীতির মূল ভিত্তি ছিল সাম্রাজ্যবাদ।
• ইউরোপের কোন রাষ্ট্রগুলো ভারতবর্ষে বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করেছিল?
উত্তর: পর্তুগাল, নেদারল্যান্ডস (ওলন্দাজ), গ্রেট ব্রিটেন (ব্রিটিশ) এবং ফ্রান্সের মতো ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলো ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করেছিল।
ক্রিয়াকলাপ (পৃষ্ঠা ৫২)
• বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সময়ে তুমি নিজেকে একজন তাঁতি হিসেবে কল্পনা করে তোমার পরিবারের লোকদের আর্থিক দুর্দশার বিষয়ে উল্লেখ করো।
উত্তর: আমি একজন সাধারণ তাঁতি। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আসার পর থেকে আমাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। কোম্পানির কর্মচারীরা আমাদের উপর অত্যাচার করে এবং আমাদের তৈরি সুতা ও রেশমের কাপড় খুব কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য করে। কোম্পানির দালাল, গোমস্তারা আমাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাদের প্রয়োজনমতো সামগ্রী তৈরি করায় এবং তা জলের দরে কিনে নেয়। অন্য কোনো ব্যবসায়ী বেশি দাম দিতে চাইলেও আমরা তাদের কাছে আমাদের জিনিস বিক্রি করতে পারি না। এই শোষণের ফলে আমাদের পরম্পরাগত বৃত্তি আজ ধ্বংসের মুখে। পরিবার নিয়ে দু’বেলা ঠিকমতো খাওয়াই এখন কঠিন হয়ে পড়েছে।
অনুশীলনী (পৃষ্ঠা ৫৩-৫৪)
১। সংক্ষিপ্ত উত্তর লেখো –
(ক) কত খ্রিস্টাব্দে বৃটিশ ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল?
উত্তর: ১৫৯৯ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
(খ) কোন নাবিক প্রথমে ভারতবর্ষে আসার জলপথ আবিষ্কার করেন?
উত্তর: পোর্তুগিজ নাবিক ভাস্কো-ডা-গামা প্রথমে ভারতবর্ষে আসার জলপথ আবিষ্কার করেন।
(গ) ওলন্দাজরা ভারতবর্ষের কোন অঞ্চলে প্রথম দুর্গটি স্থাপন করে?
উত্তর: ওলন্দাজরা ভারতবর্ষের পুলিকটে তাদের প্রথম দুর্গটি স্থাপন করে।
(ঘ) দ্বিতীয় চার্লস বোম্বাই কাদের লিজে দিয়েছিলেন?
উত্তর: ব্রিটিশ রাজকুমার দ্বিতীয় চার্লস বোম্বাই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে লিজে দিয়েছিলেন।
(ঙ) কে বৃটিশ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীকে ফরমান জারি করেছিল?
উত্তর: মোগল সম্রাট ফারুকশিয়ার ১৭১৫ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে ফরমান জারি করেছিলেন।
২। ‘ক’ অংশের সঙ্গে ‘খ’ অংশ মেলাও-
উত্তর:
| ‘ক’ অংশ | ‘খ’ অংশ |
| :— | :— |
| কলম্বাস | আমেরিকা |
| উইলিয়াম হকিন্স | ইংরেজ সংবাদবাহক |
| ভাস্কো-ডা-গামা | পোর্তুগিজ নাবিক |
| দ্বিতীয় চার্লস | (সরাসরি কোনো মিল নেই, তবে তিনি পোর্তুগিজ রাজকুমারীকে বিয়ে করেছিলেন) |
| পুলিকট | ওলন্দাজ |
৩। শূন্যস্থান পূর্ণ করো-
(ক) বৃটিশ ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে রানি প্রথম এলিজাবেথের কাছ থেকে প্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য করার জন্য রাজকীয় অনুমতি পেয়েছিল।
(খ) বাণিজ্যবাদ দ্বারা দেশের অর্থনৈতিক কাজকর্ম সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন করা হয়।
(গ) ১৬৬৯ খ্রিস্টাব্দে (প্রশ্নে উল্লিখিত ১৬৬১) দ্বিতীয় চার্লস বোম্বাই বৃটিশ ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানিকে লিজ দিয়েছিলেন।
(ঘ) ১৭১৫ খ্রিস্টাব্দে মোগল সম্রাট ফারুকশিয়ার বৃটিশ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে ব্যবসা-বাণিজ্য করার ফরমান প্রদান করেন।
(ঙ) পণ্ডিচেরী ফরাসীদের মুখ্য কার্যালয় ছিল।
৪। শুদ্ধ/অশুদ্ধ নির্ণয় করো-
(ক) ১৮ শতকে মোগল সাম্রাজ্য শক্তিশালী ছিল। – অশুদ্ধ
(খ) বৃটিশ ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি ভারতবর্ষে একমাত্র ইউরোপীয় ব্যবসায়ী কোম্পানি ছিল। – অশুদ্ধ
(গ) ভাস্কো-ডা-গামা ১৪৯২ খ্রিস্টাব্দে কলিকাতায় উপস্থিত হয়েছিলেন। – অশুদ্ধ (তিনি ১৪৯৮ খ্রিস্টাব্দে কালিকট বন্দরে এসেছিলেন)।
(ঘ) ভারতীয় কৃষকদের অত্যাচার করে রাজস্ব সংগ্রহ পদ্ধতি প্রবর্তিত হওয়ার ফলে ভারতীয় কৃষকরা ঋণগ্রস্থ হয়েছিল। – শুদ্ধ (যদিও প্রদত্ত পাঠ্যাংশে মূলত তাঁতিদের কথা বলা হয়েছে, এটি একটি ঐতিহাসিক সত্য)।
(ঙ) বাণিজ্যবাদ উপনিবেশবাদকে উৎসাহ দিয়েছিল। – শুদ্ধ
৫। দলগতভাবে আলোচনা করে প্রতিবেদন প্রস্তুত করো
(ক) ইউরোপীয় বণিক গোষ্ঠীর ভারতবর্ষে আগমনের কারণ।
উত্তর: ইউরোপীয় বণিকদের ভারতবর্ষে আগমনের প্রধান কারণগুলো হলো:
* ভারতবর্ষের মশলা, বস্ত্র, রেশম ইত্যাদির ইউরোপে ব্যাপক চাহিদা ছিল।
* ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দে তুর্কিরা কনস্টান্টিনোপল দখল করায় ইউরোপ ও প্রাচ্যের মধ্যেকার পুরোনো স্থলপথ বন্ধ হয়ে যায়।
* এই কারণে ইউরোপীয় ব্যবসায়ীরা ভারতে আসার জন্য নতুন সমুদ্রপথ খুঁজতে বাধ্য হয়।
* ইউরোপের বাণিজ্যবাদ নীতি দেশগুলোকে নতুন বাজার ও উপনিবেশ স্থাপনে উৎসাহিত করেছিল।
(খ) বাণিজ্যবাদ বলতে কী বোঝ? বাণিজ্যবাদ এবং উপনিবেশবাদের মধ্যে সম্পর্ক কী?
উত্তর: বাণিজ্যবাদ হলো একটি অর্থনৈতিক ধারণা, যেখানে একটি দেশের সমৃদ্ধি তার বাণিজ্য দ্বারা নির্ধারিত হয়। ১৬ থেকে ১৮ শতক পর্যন্ত ইউরোপের দেশগুলো সোনা ও রুপা আহরণের মাধ্যমে দেশের সম্পদ ও সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করতে চেয়েছিল।
সম্পর্ক: বাণিজ্যবাদ এবং উপনিবেশবাদের মধ্যে সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর। বাণিজ্যবাদী নীতি অনুসারে, দেশগুলো নিজেদের উৎপাদিত সামগ্রী বিক্রির জন্য বাজারের সন্ধান করতে থাকে। এই বাজারের চাহিদা মেটাতে এবং কাঁচামাল সংগ্রহের জন্য তারা বিভিন্ন দেশে উপনিবেশ স্থাপন করে। উপনিবেশগুলো মাতৃভূমির জন্য একটি নিশ্চিত বাজার এবং সম্পদের উৎস হিসেবে কাজ করত।
(গ) ভারতবর্ষের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক জীবনে ইউরোপীয় বণিকদের প্রভাব।
উত্তর: ইউরোপীয় বণিকদের আগমনে ভারতবর্ষের সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন আসে।
* অর্থনৈতিক প্রভাব: ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্যের ফলে ভারতের পরম্পরাগত কুটির শিল্প, বিশেষ করে বস্ত্রশিল্প ধ্বংস হয়ে যায়। তাঁতিদের কম দামে জিনিস বিক্রি করতে বাধ্য করা হতো, যার ফলে অনেকে তাদের পেশা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।
* সামাজিক প্রভাব: গোয়ার মতো অঞ্চলে পোর্তুগিজদের সঙ্গে স্থানীয় মহিলাদের বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপিত হওয়ায় সেখানে ইউরোপীয় সংস্কৃতির প্রভাব দেখা যায়। ধীরে ধীরে ভারতবর্ষে ইউরোপীয়দের বসতি ও প্রভাব বাড়তে থাকে, যা ভারতীয় সমাজব্যবস্থায় পরিবর্তন আনে।
৬। ভারতবর্ষের একটি মানচিত্র অঙ্কন করে পোর্তুগিজ, ওলন্দাজ, ইংরেজ এবং ফরাসিদের ব্যবসায়িক ঘাঁটিগুলো বসাও।
উত্তর: (এটি একটি অঙ্কনভিত্তিক কাজ। মানচিত্রে চিহ্নিত করার জন্য স্থানগুলির তালিকা নিচে দেওয়া হলো):
* পোর্তুগিজ: গোয়া, দমন, দিউ, কোচিন, কালিকট।
* ওলন্দাজ: পুলিকট, আগ্রা, সুরাট, মসলিপত্তনম, চুঁচুড়া।
* ইংরেজ: সুরাট, মাদ্রাজ (চেন্নাই), কলকাতা, বোম্বাই (মুম্বাই), হুগলি।
* ফরাসি: পণ্ডিচেরী, সুরাট, চন্দননগর, মাহে, কারাইকল।
৭। ইংরেজদের ভারতবর্ষে আগমনের পূর্বে ভারতবর্ষে উপলব্ধ ভারতীয় কুটির উদ্যোগসমূহের একটি তালিকা প্রস্তুত করো।
উত্তর: ইংরেজদের আগমনের পূর্বে ভারতবর্ষে উপলব্ধ প্রধান ভারতীয় কুটির শিল্পগুলো হলো:
* বস্ত্র শিল্প: সুতি ও রেশম বস্ত্র তৈরি।
* মশলা উৎপাদন ও প্রক্রিয়াকরণ।
* ধাতু শিল্প।
* মূল্যবান পাথর ও সোনা-রূপার কাজ।
৮। ‘১৭ শতকের শেষভাগ এবং ১৮ শতকের শুরুর সময় থেকেই ভারতবর্ষের ইতিহাস এক দিক নির্ণয়কারী ভূমিকা নিয়েছিল’- উক্তিটির তাৎপর্য ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: এই উক্তিটি তাৎপর্যপূর্ণ কারণ এই সময়েই ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা দেশীয় শাসকদের হাত থেকে ধীরে ধীরে ইউরোপীয় কোম্পানিগুলোর, বিশেষ করে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে চলে যেতে শুরু করে।
এর প্রধান কারণগুলো হলো:
* মোগল সাম্রাজ্যের দুর্বলতা: এই সময়ে মোগল শাসন দুর্বল হয়ে পড়েছিল।
* ব্রিটিশদের ক্ষমতা বৃদ্ধি: ১৭১৫ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট ফারুকশিয়ারের ফরমান ব্রিটিশদের বিনা শুল্কে বাণিজ্য করার মতো  সুবিধা দেয়, যা তাদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ভিত্তি শক্তিশালী করে।
* উপনিবেশের ভিত্তি স্থাপন: ব্রিটিশরা কলকাতা, মাদ্রাজ ও বোম্বাইয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থানে দুর্গ নির্মাণ করে নিজেদের সামরিক উপস্থিতি জানান দেয়।
   এই পরিবর্তনগুলোই পরবর্তীকালে ভারতের পরাধীনতার পথ প্রশস্ত করেছিল, তাই এই সময়কালকে ভারতের ইতিহাসের এক দিক নির্ণয়কারী পর্যায় বলা হয়।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *