প্রাচীন কামরূপ রাজ্য এর ভিতরের এবং অনুশীলনীর প্রশ্নোত্তর
এখানে প্রাচীন কামরূপ রাজ্য প্রশ্ন ও তার উত্তর প্রদান করা হলো।
অনুশীলনী (পৃষ্ঠা ১৯)
১। সংক্ষিপ্ত উত্তর দাও-
(ক) ভগদত্তের কন্যার নাম কী?
উত্তর: জনশ্রুতি অনুসারে ভগদত্তের কন্যার নাম ছিল ভানুমতি।
(খ) কার শাসনকালে চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ কামরূপ রাজ্য ভ্রমণ করেছিলেন?
উত্তর: রাজা ভাস্কর বর্মনের শাসনকালে চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ কামরূপ রাজ্য ভ্রমণ করেছিলেন।
(গ) কামরূপের রাজকুমারী অমৃতপ্রভা কাকে বিয়ে করেছিলেন?
উত্তর: কামরূপের রাজকুমারী অমৃতপ্রভা কাশ্মীরের রাজা মেঘবাহনকে বিয়ে করেছিলেন।
(ঘ) শালস্তম্ভ বংশের শ্রেষ্ঠ রাজা কে ছিলেন?
উত্তর: শালস্তম্ভ বংশের শাসকদের মধ্যে শ্রীহর্ষদেবের রাজত্বকালকে প্রাচীন কামরূপের ইতিহাসে একটি গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় হিসেবে গণ্য করা হয়, তাই তাকেই এই বংশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজা বলা যেতে পারে।
(ঙ) কোন রাজা কামরূপে বখতিয়ার খিলজির আক্রমণ প্রতিহত করেছিলেন?
উত্তর: রাজা পৃথু কামরূপে বখতিয়ার খিলজির আক্রমণ প্রতিহত করেছিলেন।
২। শুদ্ধ উত্তর বেছে বের করো-
(ক) বর্মন বংশের প্রতিষ্ঠাতা হলেন পুষ্য বর্মন।
(খ) ‘চি-ইউ-কি’ হিউয়েন সাঙ রচনা করেছিলেন।
(গ) কুমার ভাস্কর বর্মনের রাজত্বকালে ভাস্করাব্দ-এর সূচনা হয়।
(ঘ) প্রাচীন কামরূপ রাজ্যে রাজতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল।
৩। শূন্য স্থান পূর্ণ করো-
(ক) প্রাচীন কামরূপ রাজ্যের লোকের প্রধান জীবিকা ছিল কৃষি।
(খ) পুষ্য বর্মন বর্মন বংশ প্রতিষ্ঠা করেন।
(গ) রত্নপাল পাল বংশের শ্রেষ্ঠ রাজা ছিলেন।
(ঘ) কামরূপ রাজ্যের রাজারা পরম ভট্টারক, মহারাজা ধীরাজ, পরম পরমেশ্বর ইত্যাদি উপাধি গ্রহণ করেছিলেন।
(ঙ) ভূমি রাজস্ব কামরূপ রাজ্যের আয়ের প্রধান উৎস ছিল।
৪। সংক্ষিপ্ত টিকা লেখ-
* ভাস্কর বর্মন: ভাস্কর বর্মন ছিলেন বর্মন বংশের একজন প্রতাপশালী রাজা। তিনি অবিবাহিত থাকায় তাঁকে ‘কুমার রাজা’ নামেও অভিহিত করা হতো। তাঁর রাজত্বকালকে প্রাচীন কামরূপের ইতিহাসে এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ৫৯৪ খ্রিস্টাব্দে তাঁর সিংহাসন আরোহণের সময় থেকে ‘ভাস্করাব্দ’ বা ‘কামরূপী সন’ নামে এক নতুন যুগের সূচনা হয়। উত্তর ভারতের রাজা হর্ষবর্ধনের সঙ্গে তাঁর গভীর সম্পর্ক ছিল এবং তাঁর সময়েই চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ কামরূপ ভ্রমণ করেন।
* প্রাচীন কামরূপের শিক্ষা ব্যবস্থা: প্রাচীন কামরূপে গুরুগৃহ, সংস্কৃত টোল এবং গ্রাম্য পাঠশালায় শিক্ষা প্রদান করা হতো। শাসকরা শিক্ষার প্রসারে পৃষ্ঠপোষকতা করতেন; রাজা ভাস্কর বর্মন নিজেও একজন বিদ্বান ছিলেন। শিক্ষাকেন্দ্রগুলিতে চার বেদ, আয়ুর্বেদ, ধনুর্বেদ, ইতিহাস, পুরাণ ইত্যাদির জ্ঞান দেওয়া হতো। এর পাশাপাশি জ্যোতির্বিদ্যা, সংগীত ও নৃত্যেরও শিক্ষা দেওয়া হতো। রাজকার্যে এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে সংস্কৃত ভাষার ব্যাপক প্রচলন ছিল।
* ভগদত্ত: ভগদত্ত ছিলেন নরকাসুরের পুত্র এবং কামরূপের রাজা। মহাভারতে তাঁর বীরত্বের কাহিনীর উল্লেখ পাওয়া যায়। তিনি তাঁর কন্যা ভানুমতির বিবাহ দুর্যোধনের সঙ্গে দিয়েছিলেন এবং মহাভারতের যুদ্ধে কৌরবদের পক্ষে যুদ্ধ করেছিলেন। গুয়াহাটির দিঘলী পুখুরিটি তিনি তাঁর কন্যার স্বয়ম্বরের জন্য খনন করিয়েছিলেন বলে জনশ্রুতি আছে।
* প্রাচীন কামরূপের ধর্ম: প্রাচীন কামরূপে প্রকৃতির উপাসনার প্রচলন ছিল; মানুষ গাছ, পাথর, পাহাড় ও নদীকে দেবতারূপে গণ্য করত। শৈব ধর্ম বা শিবের উপাসনা প্রাচীনকাল থেকেই প্রচলিত ছিল। কামরূপ শক্তি উপাসনারও অন্যতম প্রধান কেন্দ্র ছিল, যার মধ্যে কামাখ্যা দেবীর মন্দির প্রধান। দুর্গা, কালী, উমার মতো দেবীদের পূজা করা হতো। এছাড়া, বিষ্ণু উপাসনা এবং সূর্য পূজারও প্রচলন ছিল।
* দেবদাসী প্রথা: প্রাচীন কামরূপে দেবদাসী প্রথার প্রচলন ছিল, যা এক শ্রেণির মহিলাদের মধ্যে নৃত্য-গীতের চর্চার প্রমাণ দেয়। বনামালা বর্মনের তাম্র ফলকে দেবদাসী প্রথার উল্লেখ পাওয়া যায় এবং রাজা হেতুকাচালিন দেবদাসীদের বাসস্থানের জন্য মন্দির নির্মাণ করেছিলেন বলেও লিপিবদ্ধ আছে। প্রাচীন মন্দিরগুলিতে খোদিত নৃত্যরতা নারীমূর্তিগুলোও এই প্রথার ইঙ্গিত দেয়।
৫। প্রাচীন কামরূপ রাজ্যের প্রশাসন ব্যবস্থা ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: প্রাচীন কামরূপ রাজ্যে রাজতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার প্রচলন ছিল, যেখানে রাজাই ছিলেন সর্বেসর্বা। রাজারা নিজেদের ঈশ্বরের অংশ হিসেবে দেখাতেন এবং ‘মহারাজা ধীরাজ’-এর মতো উপাধি গ্রহণ করতেন।
শাসনকার্যের সুবিধার জন্য রাজ্যকে ভুক্তি, মণ্ডল, বিষয়, পুর এবং গ্রামের মতো বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত করা হয়েছিল। শাসন ব্যবস্থায় মন্ত্রী পরিষদের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল, যেখানে অমাত্য, সচিব, মন্ত্রীর মতো পদাধিকারীরা থাকতেন। রাজ্যের সেনাবাহিনীতে অশ্বারোহী, নৌ-বাহিনী, হস্তী বাহিনী ও পদাতিক সৈন্য ছিল। ভূমি রাজস্বই ছিল রাজ্যের আয়ের প্রধান উৎস।
৬। প্রাচীন কামরূপ সম্পর্কে জ্ঞান আহরণ করতে শিলালিপিগুলো কীভাবে সাহায্য করে ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: শিলালিপি, তাম্রলিপি এবং স্তম্ভলিপিগুলো প্রাচীন কামরূপের ইতিহাস জানার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক উপকরণ। এই লিপিগুলো থেকে নিম্নলিখিত বিষয়গুলি জানা যায়:
* রাজবংশের তথ্য: ডুবি এবং নিধানপুরের তাম্রলিপি থেকে বর্মন বংশের রাজা পুষ্য বর্মন এবং ভাস্কর বর্মনের বিষয়ে জানা যায়।
* শাসন ব্যবস্থা: এই লিপিগুলো থেকে রাজ্যের প্রশাসনিক বিভাগ, যেমন— ভুক্তি, মণ্ডল, বিষয় ইত্যাদি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।
* ধর্ম ও সমাজ: রাজাদের ভূমিদানের তথ্য থেকে তৎকালীন ধর্মীয় বিশ্বাস (যেমন- ব্রাহ্মণদের জমিদান) এবং দেবদাসী প্রথার মতো সামাজিক রীতিনীতি সম্পর্কে জানা যায়।
* ঐতিহাসিক ঘটনা: উত্তর গুয়াহাটির কানাই বরশীবোয়া শিলালিপি থেকে রাজা পৃথুর হাতে বখতিয়ার খিলজির পরাজয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনার কথা জানা যায়।
এইভাবে, শিলালিপিগুলো তৎকালীন রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক অবস্থার একটি নির্ভরযোগ্য চিত্র তুলে ধরে।
৭। বর্তমান অসমের মানচিত্র অঙ্কন করে বর্মন, শালস্তম্ভ ও পাল বংশের রাজধানী চিহ্নিত করো। (শিক্ষকের সাহায্য নেবে)।
উত্তর: (এটি একটি মানচিত্র-ভিত্তিক কাজ। নিচে তথ্যগুলো দেওয়া হলো যা দিয়ে মানচিত্রটি আঁকা যাবে।)
একটি বর্তমান অসমের মানচিত্র আঁকতে হবে। তারপর নিম্নলিখিত স্থানগুলি চিহ্নিত করতে হবে:
* বর্মন বংশ: এই বংশের রাজধানী ছিল প্রাগজ্যোতিষপুর, যা বর্তমান গুয়াহাটি অঞ্চলে অবস্থিত। মানচিত্রে গুয়াহাটি চিহ্নিত করে সেটিকে বর্মন বংশের রাজধানী হিসেবে দেখাতে হবে।
* শালস্তম্ভ বংশ: এই বংশের শাসকরা তেজপুর থেকেও শাসনকার্য পরিচালনা করতেন বলে মনে করা হয়। তাই মানচিত্রে তেজপুর চিহ্নিত করতে হবে।
* পাল বংশ: পাল বংশের শ্রেষ্ঠ রাজা রত্নপাল ‘দুর্জয়’ নামক একটি নগরকে রাজধানী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। ঐতিহাসিকদের মতে, এই নগরটি বর্তমান গুয়াহাটির পানবাজার, আমবাড়ি, উজান বাজার অঞ্চলে অবস্থিত ছিল। তাই, গুয়াহাটি অঞ্চলকে আবার পাল বংশের রাজধানী হিসেবেও চিহ্নিত করতে হবে।
